সারপ্রাইজ উইশ!
আমরা আমেরিকায় এসেছি ২০০১ সালে, প্রথম বসত করেছি ওয়েস্ট
ভার্জিনিয়া নামক পাহাড় ঘেরা রাজ্যে। এত সুন্দর রাজ্য
ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, যে সৌন্দর্য্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
বর্তমান মিসিসিপি রাজ্যে চলে আসার আগে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে তিন বছর
ছিলাম। যদিও ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া নামের সাথে অনেকেই 'ভার্জিনিয়া'কে গুলিয়ে ফেলে। দুটি আলাদা আলাদা রাজ্য, কিন্তু
পাশাপাশি।
যাই হোক,
প্লেন থেকে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার মাটিতে পা দিতেই বুকের মধ্যে মেঘের গুরু
গুরু শুনতে পেয়েছিলাম! চারদিক ফাঁকা, নীরব, শুনসান চারিধার! কোথাও কোন জনবসতি না দেখে আমার মাথাটা বেশ কিছুদিনের জন্য
এলোমেলো হয়ে গেছিল। বাঙালী খুঁজে খুঁজে হয়রান আমরা, বাঙালীর
দেখা তো পাচ্ছিলামই না, এমনকী গুজরাটী বা তেলেগুভাষী কাউকেও
পাচ্ছিলাম না। কানাডাতে অবস্থানরত বড়দা ফোন করে, আমি ফোনের
মধ্যেই হাপুস নয়নে কাঁদি। বড়দার মন এমনিতেই নরম, তার উপর
একমাত্র বোন হওয়ার কিছু বাড়তি সুবিধা যোগ হয়েছে বলেই বড়দা ক্যালিফোর্ণিয়া থেকে
শুরু করে তার পরিচিত যে যেখানে আছে, সবার কাছে খোঁজ নিতে
শুরু করে দিল, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার কোথাও কী কোন বাঙালী
পরিবার আছে কিনা! মিশন সাকসেসফুল! এর মারফৎ, ওর মারফৎ ঘুরে ঘুরে
সংবাদ পাওয়া গেলো, আমাদের ক্লার্কসবার্গ শহরেই যে হাসপাতাল
আছে, সেখানে চিন্ময় দত্ত নামে একজন বাঙালী ডাক্তার আছেন। স্বামী-স্ত্রী,
দুই মেয়ে নিয়ে উনার সংসার।
ফোন বুক থেকে নাম ধরে ধরে বের করা হলো নাম, ডঃ
ড্যাটা নামে একজন আছেন। কিশোরী মৌটুসীকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম চিন্ময়
দত্তের খোঁজ বের করার জন্য। ওতো জানেনা, 'দত্ত'কে ড্যাটা বলে এখানে! আমিই বললাম, ড্যাটা হোক বা
ডাটা হোক, ইনাকেই আমরা খুঁজছি। বললাম,
" ফোন করো মামনি, আমি তো ইংলিশ মিংলিশ
ভালো বুঝবোনা, তুমিই প্রথমে কথা বলো।" মৌটুসী ডায়াল করে
ভয়েস মেসেজ অপশানে গিয়ে আমার শেখানো বুলি আওড়ে বললো, " আমরা
এখানে এসেছি দশ দিন হয়ে গেছে, কোন বাঙালী খুঁজে পাইনি,
আপনাদের সাথে পরিচিত হতে চাই"।
ঘন্টা তিনেক পরেই একটা কল পেলাম, " আমি ডঃ
ড্যাটা বলছি। কিচ্ছু অসুবিধা নেই, আমরা এখানে
আছি গত ২৭ বছর ধরে, একমাত্র বাঙালী ফ্যামিলি। প্রতিদিন আমার
স্ত্রী শুভ্রা মুরগীর ঝোল রাঁধে, আমি ভাত খাই। আমার দুটো
মেয়ে আছে, অনেক দূরে থাকে। " এমন মজার কথা শুনে আমার
খুব ভাল লাগলো, কিন্তু উনার স্ত্রীকে বেশ ব্যক্তিত্বময়ী মনে
হলো, তবে কথা-বার্তায় উনিও বেশ আন্তরিক ছিলেন।
প্রথম পরিচয়েই উনারা এত আপন করে কথা বলছিলেন যে ভালোলাগায়, আনন্দে,
বল -ভরসায় মনটা ভরে গিয়েছিল। আমাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠতে বড়জোর
দুই দিন লেগেছিল। এরপর থেকে আমি আর আমার উত্তম ডঃ
ড্যাটাকে 'দাদা' বলে ডাকতাম,আমার মেয়েরা ডাকতো 'আংকেল'।
উনার স্ত্রীকে ডাকতাম বৌদি। এভাবেই প্রথম বছর কেটে গেল।
দাদা এবং শুভ্রা বৌদিকে আমাদের পাশে পেয়ে আমরা সবদিক থেকে ভাল
থাকতে শুরু করলাম।
কথায় কথায় জেনেছিলাম, ২৪শে মে, ১৯৬৯
সালে উনাদের বিয়ে হয়েছিল। সেই হিসেবে ২৪শে মে, ২০০৩ সালে উনাদের বিয়ের বয়স দাঁড়ায় ৩৪ বছর। এই দাদা বৌদির ভালোবাসায় আমরা
সিক্ত ছিলাম, শুধুই পেয়েছি উনাদের কাছ থেকে। মিলিয়নিয়ার দাদা,
আমাদের মত অতি সাধারণ মানুষের পক্ষে টাকা খরচ করে উনাদের ভালোবাসার
প্রতিদান দেয়ার চেষ্টা বৃথা! তাছাড়া ভালোবাসা বা বন্ধুত্ব দান-প্রতিদানের জিনিস
না। আমি ১৬ই মে তারিখে দত্ত বৌদিকে ফোন করে বলেছি, ২৪শে মে
তারিখে আমাদের বাসায় যেন ডিনার করেন। ৩০ বছর ধরে আমেরিকায় থাকতে থাকতে উনারা
দৈনন্দিন জীবনে আমেরিকান হয়ে গেছিলেন, শুধু বাংলা ভাষাটুকু ভুলে
যাননি, এটুকুই ভরসার কথা। বৌদি তো মহাখুশী, ২৪ তারিখ বিকেলেই চলে আসবেন উনারা, এমনটাই ঠিক হলো।
ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলেছিলাম, ঐদিন যেন বৌদি শাড়ী পড়ে আসে।
আমাদের বাড়ীর ব্যাক ইয়ার্ডে গোলাপের ঝোপ ছিল, সেখানে ঐ
সময়টাতেই গাছ ঝাঁপিয়ে গোলাপ ফুটেছিল। দুইদিন আগেই আমি মাত্র দুই ডলার খরচ করে খুব
সুন্দর মুঘল কাজ করা ছোট একটা ফুলদানী কিনে এনেছিলাম। ২৪ তারিখ দুপুরে ঝোপ থেকে
কাঁচি দিয়ে ৩৪টি গোলাপ কেটে নিয়ে এসেছি, দুই হাতের চামড়া গোলাপের
কাঁটার আঁচরে ক্ষত-বিক্ষত, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ ছিল ্না আমার,
৩৪ গোলাপসহ মুঘল কাজের ফুলদানী রেডী করলাম, পোলাও
মাংস রান্না করেছি, কেক বেক করেছি যেখানে লেখা ছিল,
" হ্যাপী ৩৪তম শুভ বিবাহ বার্ষিকী!" আসমানীর কুঁড়েঘর
যতটুকু সম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে মিলিয়নিয়ার দাদা-বৌদির জন্য রেডী করে
রেখেছিলাম।
যথাসময়ে দত্ত দাদা এবং দত্ত বৌদি বিশাল গাড়ী থেকে নেমে এলেন। কত
বছর পর বৌদি শাড়ী পড়েছে কে জানে! দারুণ সুন্দর বটল গ্রীন বেনারসী পড়ে এসেছেন।
উনাদের দুজনকেই ঘরে এনে বসিয়েছি, একটু স্থিতিশীল হতে দিয়েছি, মেয়ে মিশাকে ক্যামেরা রেডী রাখতে বলেছিলাম আগেই। সব যখন প্রস্তুত,
৩৪ গোলাপসহ ফুলদানী এবং হ্যাপী ম্যারেজ অ্যানিভার্সারী কার্ড ছোট্ট
মিথীলার হাত দিয়েই উনাদের দুজনকে দিলাম।
দুজনেই হতভম্ব! দুই কী ছয় সেকেন্ড, বৌদি দুই
হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করেছেন। দত্ত দাদা কেমন যেন ক্যাবলা ক্যাবলা হাসি
দিচ্ছেন। উনাদের দুজনের প্রতিক্রিয়া দেখে আমরা হতভম্ব। শুভেচ্ছা পেয়ে কাউকে কাঁদতে
দেখিনি এর আগে! কয়েক মিনিট পর বৌদি হেঁচকী তুলতে তুলতে কোনরকমে বললো,
"এমন ভালোবাসা আমি কোনদিন পাইনি, আমার ম্যারেজ
অ্যানিভার্সারী আমারই মনে থাকেনা, মিঠুন তুমি মনে রেখেছো,
গুনে গুনে ৩৪ গোলাপ যোগার করেছো, আজ তুমি যে
আনন্দ আমাকে দিলে, জীবনেও ভুলবো না।"
বৌদির দেখা দেখি দত্ত দাদাও বলছে,
"
ইয়া, মিঠুন তুমি করেছো কি? আমিই তো ভুলে গেছিলাম আমাদের বিয়ে ৩৪ বছর হয়ে গেছে। কী ব্যাপার, তুমি কী করে মনে রাখলে"?
দাদা-বৌদিকে খুব আদর-যত্ন করে খাওয়ার টেবিলে এনে
বসালাম। ৩০ বছরের উপর উনারা আমেরিকায় আছেন, আমেরিকান খাবারেই
অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। লাউঘন্ট, মোচার ঘন্ট, রুই মাছের কালিয়ার স্বাদও মনে হয় ভুলে গেছেন। আমাদের ওখানে রুই মাছ পাওয়া
যায়নি, কিন্তু স্যালমন মাছ দিয়েই কালিয়া বানিয়েছি, ক্যানের মোচা দিয়ে ঘন্ট বানিয়েছি, চিংড়ি মালাইকারী,
চিকেন কারী, পোলাও রেঁধেছিলাম। উনারা খেয়েছেন পাখীর
আহারের মত, কিন্তু খুব খুশী হয়েছেন আয়োজন দেখে। সব শেষে
উনাদের জন্য আরেকটু চমক ছিল, মিশার হাতে বানানো কেক। বারো
বছরের মিশা এত সুন্দর করে কেক বেক করেছে, আংকেল আন্টি তো
মহাখুশী। বৌদি তো বার বার শুধু চোখই মুছে গেলো, আর দাদাও
কেমন যেন লজ্জা মেশানো হাসিতে মুখ ভরিয়ে রাখলো। আমার খুব ভালো লেগেছে উনাদেরকে অমন
সারপ্রাইজ উইশ করতে পেরে।
২০০৪ সালে আমরা ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ছেড়ে চলে আসি মিসিসিপিতে।
মাঝে মাঝেই শুভ দিনগুলো মনে পড়ে, দিন ধরে ফোন করি, শুভ
বিবাহবার্ষিকী অথবা শুভ জন্মদিন বলি। অদর্শনে মানুষ অনেক কিছুই ভুলে যায়, অনেককেও ভুলে যায়। আমরাও অনেক কিছু ভুলে গেছি, অনেকের
কথা সব সময় মনেও আসে না। দত্ত দাদা এবং দত্ত বৌদিকে ভুলে যাওয়ার কোন কারণই নেই,
তারপরেও ভুলে থাকতে হয়। জীবনের বাস্তবতাই আমাদের সকলকে, উভয়পক্ষকে অনেক কিছু থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ২০০৩ সালের পর কয়েকবারই ২৪শে
মে তারিখে আমি দাদা-বৌদিকে হ্যাপী উইশ করেছি ফোনে।
২০১৩ সালের ২৪শে মে তারিখের সন্ধ্যেবেলা আবার দত্তদাদার ফোনে কল
দিলাম। ফোন তুলে হ্যালো বলতেই বললাম,
"
হ্যাপী ৪৪তম শুভ বিবাহবার্ষিকী দাদা! আপনারা দু'জন শতায়ু হোন"!
দাদার সেই একই ভঙ্গীতে উত্তর, " কী ব্যাপার মিঠুন
বলোতো, তুমি কী আমাদের বিয়ের মন্ত্র পড়িয়েছিলে নাকি? কী করে মনে রাখো এত? এই নাও, তোমার
বৌদিকে দিচ্ছি। শুভ্রা দেখো কে, মিঠুন, কী অসম্ভব ব্যাপার!"
বৌদি হ্যালো বলতেই বললাম, " বৌদি, অনেক দূরে চলে এসেছি, তারপরেও ২৪শে মে ভুলিনি। শুভ
৪৪তম বিবাহবার্ষিকী, আপনাদের শতায়ু কামনা করছি"।
"থ্যাঙ্ক ইউ মিঠুন, তোমার ফোন পেয়ে অবাক হয়ে যাই,
কী করে মনে রেখেছো ৪৪ বছর বিয়ে হয়েছে আমাদের? "
"বৌদি, আপনাদের কথা যদি ভুলে যাই, তাহলে কী করে চলে! আপনাদের মত সুখী দম্পতীকে উইশ করতে পারছি, আমারও আনন্দ হচ্ছে। মানুষকে অবাক হতে দেখলে আমার খুব ভাল লাগে। এ পর্যন্ত
যতবার আপনাদেরকে ফোন করে উইশ করেছি, আপনারা সত্যি সত্যি খুব
অবাক হয়েছেন। মনে হয় যেন আমার কন্ঠস্বর শুনেও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না!"
-মিঠুন, তুমি আমাকে অনেকভাবে অবাক করেছো। ১৫ নভেম্বার
আমার জন্মদিনেও তুমি নিজের বাড়ীতে আমাকে দিয়ে 'সারপ্রাইজ কেক'
কাটিয়েছিলে। কিছুই ভুলিনি, ভালোবাসা কেউ ভুলতে
পারেনা! তুমি সত্যি সত্যি একটা আস্ত পাগলী। আমরা এখন ফ্লোরিডাতে, মেয়েদেরকে সাথে করে রেস্টুরেন্টে এসেছি।"
-তাহলে এনজয় করুণ বাকী সময়, আবার পরে কথা হবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন