সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আবু জাফর

আমার ছবি আঁকার সাতকাহন

কাশ ফুলের সারি, বাঁকা নদীর পারে একে বেঁকে সরু মেঠ পথ, দু'একটা খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে, একটু হাঁটলেই রাস্তার দুপাশে বাবলা গাছের সারি, ছোট ছোটো হলুদ ফুলে ছেয়ে আছে। একটু হালকা মিষ্টি গন্ধে মৌমাছিদের গুন গুনে শব্দ। চড়ুই পাখীরা খেলায় মেতে উড়ে আসে আর যায়। টুনটুনিদের গান, সবুজ ধানে ভরা চারি দিক বাতাসের আলতো ছোঁয়াতে ঢেউ খেলা সুখ উল্লাসে মিশে গেছে ঐ আকাশ দূর দিগন্তে। প্রকৃতির অফুরন্ত সুন্দরে বাংলাদেশের একটা গ্রাম ঝিলনা। চারু শিল্পী আবু জাফর ঐ গ্রামেই হাটি হাটি পা বাড়িয়ে প্রকৃতির অপরূপে মোহিত চোখে দেখা সুন্দরকে কলমের রেখাতে রূপদানে শুরু করে শিল্প যাত্রা মাত্র ৬ বছর বয়েসে। রাফ খাতার উপরে খেজুর গাছ, পালতোলা নৌকা, কাশ ফুল, উরন্ত বক, পাখী আর মেঘের ভেলা মাঝ খানে সুন্ধ্রর কোরে "আবু জাফর মুহাম্মাদ সালেহ"আনআনন্দে ভরা জাফর মুখে মুছকি হাসি।
এমন করেই শিল্পী আবু জাফর চারু শিল্প জগতে প্রবেশ করেন। মেয়েদের রুমালে ফুল, টিয়ে পাখী, আর ঘরে বাঁধানো মেয়েদের কারু কাজে হাতের শেলাই এ ছিল জাফরের শিল্প যাত্রার প্রথম দিকের ছবি। বাড়ীতে ছবি আঁকার নিষেধ থাকলেও জাফর লুকিয়ে লুকিয়ে আঁকতে থাকে ছবি অনেকেরই অজান্তে রাতে পড়ার টেবিলে হারিকানের আলোতে। মা এবং ভাই বোনেরা জানলেও বাবা যাতে একেবারেই ছবি আঁকার ব্যাপারটা জানতে নাপারে সে ছিল সবার কাম্য। ক্লাস ৭ এর ছাত্র, হাইস্কুলের কাছেই হিন্দু বাড়ীতে দুর্গা পূজার আয়োজন দুর্গা তৈরি, স্কুলে এসে দুর্গাকে আঁকার প্রচণ্ড ইচ্ছাকে ধরে রাখতে না পেরে টিফিনের বিরতির বেল, সবাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর জাফর শুরু করে চক দিয়ে ব্লাকবোর্ডে দুর্গার ছবি আঁকা, আঁকতে আঁকতে কখন যে সময় পরিয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। শিক্ষক আর অন্যান্য ছাত্র সবাই ক্লাসে আসছে। তড়িঘড়ি করে জাফর টেবিলে এসে বসে অনেকটা ভয়ে আর ছবি আঁকার আনন্দে ব্লাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে ভাবছে কি হবে। শিক্ষক ব্লাকবোর্ডের ছবি দেখে অনেকটা থমকে ছাত্রদেরকে কে এঁকেছে? সবাই চুপ। অনেকটা ভয়ে জাফর দাড়িয়ে জি আমি আকেছি। এর পরে শিক্ষক তাকে দুইহাত ধরে বেশ করে লাঠি মেরে বল্ল আর যেন কোন দিন এরকম ছবি আঁকা না হয়। প্রচণ্ড ব্যাথা নিয়ে জাফর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল যখনই সময় পাবে ঐ ব্লাকবোর্ডে ছবি আঁকবে। সেদিন থেকে শুরু হয় জাফরের নতুন যাত্রা সম্বত সেইদিনের ঐ প্রতিজ্ঞাতেই আজকে শিল্পী আবু জাফরের বিচারন শিল্প জগতে। এর পরে ক্রমাগত জাফর আঁকতে থাকে ছবি স্কুলের নবম দশম শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদের বিজ্ঞানের ছবির খাতা আর বিভিন্ন সময় পাখী আর পালতোলা নৌকার ছবি। হাইস্কুল শেষ করে জাফর বেরাতে আশে ঢাকা চাচার বাসা। তেজকুনি পাড়া, ১৯৮৪ সনে। প্রতি দিন ঘরথেকে বের হয় জাফর আর্ট কলেজের জন্য, ভাল কোন তথ্য নাথাকায় শহরের অলি গলি সকাল থেকে সন্ধ্যা দিনের পরে দিন খুঁজেও যখন খুঁজে পাচ্ছিলনা চারুকলা একদিন অনেক হাঁটাহাঁটির পরে রমনা পার্কে দেখল অনেক লোক ছবি আঁকছে। খুশীতে আত্মহারা বেশ ঘুরে ঘুরে দেখার পর একজনের ছবি আঁকা বেশ করে দেখতে দেখতে প্রায় সন্ধ্যা। সবাই চলে যাবে এমন সময় জাফর একজন কে বল্ল আপনি কি শিল্পী সে হেসে বল্ল নারে পাগল আমি মাত্র প্রথম বর্ষের ছাত্র আমার নাম আজাদ। তুমি কি চারুকলাতে পড়তে চাইছ? মাথা নেড়ে হাঁ । আপনি যদি আমাকে আপনার ঠিকানা দেন তাহলে বেশ খুশী হব। আমি আপনার সাথে দেখা করবো আর ছবি আঁকা শিখব।সেই হল প্রথম ছবি আঁকা কারো সাথে পরিচয়। এরপরে নিয়মিত জাফর আজাদের সাথে দেখা করত চারুকলাতে ভর্তি প্রস্তুতি সে সময় অশোক কর্মকারের সাথে পরিচয় এবং তার কাছে শিখতে থাখেন ছবি আঁকা। চারুকলাতে ভর্তি এবারে শুরু হল দিন রাত ড্রয়িং করার পালা। হোটেল সোনারগাঁ ঢাকা, শিল্পী কালিদাস কর্মকারের প্রদর্শনী। চারুকলার ক্লাসমেডদের সাথে একটা ঝোলা ব্যাগ ভিতরে স্কেচ বই। কালিদাস ডেকে বলল দেখি কেমন ড্রইং করো তুমি? এই ১০টা কোরে আঁকি প্রতিদিন। তখন কালিদাস বোল্লেন ১০টা ছবি এঁকে শিল্পী হতে পারবেনা আমি যখন ছাত্র ছিলাম ৭ দিনে ঐ স্কেচ বই শেষ কোরে ফেলতাম। এবারে জাফর প্রতিজ্ঞা করলো ৭ দিন নয় ১ রাতেই শেষ করব। হোলো নতুন অঙ্গীকার চারুকলা থেকে বাসা, রাতের খাবার শেষে প্রতিদিন কমলাপুর ট্রেন স্টেশন ড্রইং সরা রাত।
১৯৮৭ শিতের বিকেল, সোনালী রঙ্গের আলতো ছোঁয়াতে নারকেল গাছের চূড়া নীল আকাশ,চারুকলার বামদিকের প্রবেশ দারে জাফর আর নাইমা রমনা পার্ক থেকে স্কেস শেষ। নাইমা জাফরকে উদ্দিশ্য করে দাদা তুই কি বিদেশে যাবি? জাফর একটু থমকে গিয়ে নাইমার দিকে তাকিয়ে - একটু মুচকি হাসিতে " পাগলী সে ভাগ্য নিয়ে আমি জন্মিনি। বিদেশ - ওটা সবার জন্য নয়। ওটা উচ্চ বিত্তদের ভাবনা, আমার মত নিম্ন মধ্য বিত্ত পরিবারের ছেলেদের ভাবনাটাই একটা যেন আমবস্যা রাতে নতুন এক চাঁদের মত।এসময় থেকেই জাফর আধবিমূর্ত ছবি আঁকা শুরু করেন, যার বিষয় বস্তু ছিল বেশির ভাগই নারী মুক্তি এবং নারী বেধনা নিয়ে। ১৯৮৯ সনে শিল্পী জাফর লায়ন্স ক্লাবের সহযোগিতাতে একক প্রদর্শনী করতে চলে আসেন বারমিংহাম ইউকে। দীর্ঘ ৬ মাস থেকে আবার চলে জান বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ফিরে শিল্পী জাফর ব্রিটিশ কাউন্সিলে প্রথম বাংলাদেশে একক প্রদর্শনী করে নতুন মাত্রাতে ছবি আঁকতে থাকেন এর পরে ১৯৯০ সালে চলে আসেন ইউকে শিল্পকলাকে নতুন করে আবিষ্কার করার লক্ষ্য। শুরু হয় প্রবাসী জীবন। ফেলে আসা বাংলাদেশ আর নতুন দেশের নতুন প্রকৃতি শিল্পমনে প্রচণ্ড তোলপাড়। পেইন্টিং থেকে শুরু করে কাজ করছেন সব জানা মাধ্যমে। কখনও ড্রয়িং, পেইন্টিং আবার স্কাল্পচার। Goldsmiths কলেজে থাকা অবস্থাতেই তিনি নতুন করে ছবি আঁকার ইচ্ছাতে শুরু কোরে "ণীল রঙ্গের ণীচে" এবং আরও অনেক নতুন ছবি এ গুলো ছিল অনেকটা গল্পের আদলে। গল্পের যেমন শেষ নেই অনুভূতি নতুন রূপের এ শিল্পকর্মও ছিল অনেকটা ওরকম। বছরের পর বছর শিল্পী জাফর কাজ করতে থাকেন এবং গল্প হারিয়ে নতুন গল্পের রূপ।বিগত প্রায় দুই দশক ধরে শিল্পী জাফর বিলেতে বহু আর্ট গ্যালারি আর স্কাল্পচার পার্কে প্রদর্শনী কোরে চলছেন। হাজার হাজার লোক দেখছে তাঁর চিত্র কর্ম। এই সফলতার পিছনে রয়েছে ত্যাগ আর প্রচণ্ড শিল্প সাধনা। ২০০৬ সাল থেকে জাফর নতুন ফর্মে স্কাল্পচার সৃষ্টির মাঝে আত্ম প্রকাশ করে এবং সেই থেকে ঐ স্কাল্পচার মূলধারাতে কেন্দ্র করে নির্মাণ করছে নতুন কাজ " Hope"শিল্পী জাফরের ১৯৯৫ সালে প্রথম স্টুডিও নেন brookhall Village, Langkeshire UK. এখান থেকেই তাঁর শিল্পকলার আর এক নতুন রূপ লাভ করে। বরফ দিয়ে নির্মাণ করেন তাঁর প্রথম সময় ভিত্তিক শিল্পকর্ম। আর বিশাল বিশাল কাপড়ে পেইন্টিং এর মধ্য রয়ছে Midnight Dream, Mist of Twilight, Dancing through night and day, On My Way, Under the sea এবং আরও অনেক।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রিতা রায় মিঠু

সেদিন সন্ধ্যায় যা ঘটেছিল ২৮শে ফেব্রুয়ারী ছিল হিমাংশু ও মিত্রার দশম বিবাহবার্ষিকী।   দিনটি ছিল মঙ্গলবার , তাই কারোরই ছুটি ছিলোনা।   প্রবাসে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো সপ্তাহের শনিবার বা রবিবার উদযাপন করা হয়ে থাকে , নাহলে শুক্রবার সন্ধ্যাটিও মন্দ হয়না।   আমরা সবাই মিলে মিশে ঠিক করেছিলাম মিত্রা - হিমাংশুর দশম বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করবো ৯ই মার্চ , শুক্রবার সন্ধ্যাতে।

আবু জাফর

হোম পেজে যেতে এখানে ক্লিক করুন। বিস্তারিত পড়ার জন্য লেখকের নামের ওপর ক্লিক করুন কুয়াশায় সকাল সকাল বেলা উঠে, জানালার ওই দিকে তাকিয়ে দেখি কুয়াশা ভরা সকাল খেলছে লুকোচুরি তার নিজের গতিধারায়। ভাবছি যাব লন্ডনে। অনেকদিন হলো দেখা হয়না চিত্র প্রদর্শনী।  বেশ শীত শীত ভাব, পাহাড়ের উপর থেকে নেমে দেখি প্রচন্ড কুয়াশায় ভরে গেছে পাদদেশ। দেখা যায় না তেমন কিছু। কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে প্রকৃতি। ঘাসের উপরে শুকনো পাতাগুলো আমার পায়ের স্পর্শে গাইছে শীতের গান, মূর্মুর শব্দে। সকালের পাখিরাও গান ধরেছে গাছের চূড়ায়, ওই মগডালে। মায়ায় জড়ানো সকাল সত্যিই এক কল্পলোকের নতুন গল্প। রাস্তার এপারে দাঁড়িয়ে একটু নিঃশ্বাস নিলাম । যেতে হবে ওই পারে। দেখছি ডানে-বামে কোন গাড়ি আসছে কিনা। ধীরে ধীরে হেঁটে যাবো স্টেশনে। লাগবে প্রায় 30 মিনিট। আঁকাবাঁকা গ্রাম পথে হেটে যেতে কি যে মজা, এই গ্রামে না এলে তা একেবারেই উপলব্ধি করা যায় না। দুই পাহাড়ের পাদদেশের ছোট্ট একটা নদী বয়ে চলেছে ধীরে ধীরে।মাঝে মাঝে দু'একটা 

রীতা রায় মিঠু

সারপ্রাইজ উইশ! আমরা আমেরিকায় এসেছি ২০০১ সালে , প্রথম বসত করেছি ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া নামক পাহাড় ঘেরা রাজ্যে। এত সুন্দর   রাজ্য ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া , যে সৌন্দর্য্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।   বর্তমান মিসিসিপি রাজ্যে চলে আসার আগে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে তিন বছর ছিলাম। যদিও ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া নামের সাথে অনেকেই ' ভার্জিনিয়া ' কে গুলিয়ে ফেলে। দুটি আলাদা আলাদা রাজ্য , কিন্তু পাশাপাশি।